• সন্ধ্যা ৭:৫৭ মিনিট বৃহস্পতিবার
  • ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  • ঋতু : গ্রীষ্মকাল
  • ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
এই মাত্র পাওয়া খবর :
বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মাকসুদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বউয়ের মামলা সোনারগাঁয়ে ৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৯ প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ, ৪ জন বাতিল সোনারগাঁয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যুবককে অপহরন করে নির্যাতনের অভিযোগ সানাউল্লাহকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে হত্যা চেষ্টা ও ১৫ মামলার আসামী গ্রেপ্তার বন্দরে ইউএনও অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যের আত্মহত্যা সোনারগাঁয়ে ২দিন ধরে মাদ্রাসা ছাত্র নিখোঁজ সোনারগাঁয়ে দুই ব্যাক্তি আটক, ৪৯ লাখ জাল টাকা উদ্ধার অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন আজিজুল ইসলাম মুকুল সোনারগাঁয়ে ৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৪ জনের মনোনয়নপত্র দাখিল তাপদাহের প্রভাব পড়েছে সোনারগাঁয়ের বাজার ও মার্কেটগুলোতে মাহফুজুর রহমান কালামের নির্বাচনী প্রচারনায় নেতাকর্মীর ঢল সোনারগাঁ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভুল চিকিৎসায় নারীর মৃত্যুর অভিযোগ সোনারগাঁ থেকে বাড়ি ফেরার পথে লাশ হলেন পিতা-পুত্র তীব্র গরমের কারনে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা খুলবে ২৮ এপ্রিল! অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন মাহফুজুর রহমান কালাম সোনারগাঁয়ে প্রাথমিকে অনলাইন বদলী আবেদনে অনিয়মের অভিযোগ জামপুরে ৪টি ওয়ার্ডের নেতাকর্মী নিয়ে বাবুল ওমরের নির্বাচনী প্রচারনা সভা সোনারগাঁয়ে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মী বেচা-কেনার হিড়িক সোনারগাঁয়ে নেতাকর্মী বেচা-কেনার হিড়িক সোনারগাঁয়ে করোনা যোদ্ধাকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে হত্যার চেষ্টা
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: ঐতিহাসিকতা ভূমিকা

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: ঐতিহাসিকতা ভূমিকা

Logo


নিউজ সোনারগাঁ টুয়েন্টিফোর ডটকমঃ বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সাল ছিল সর্বাধিক বেদনাদায়ক এবং একইসঙ্গে সর্বাধিক সাফল্যজনক একটি অধ্যায়। বেদনার বিষয় এই কারণে যে, এ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের লাগামহীন অত্যাচার-অবিচার ও জিঘাংসার শিকার হয়ে লাখো বাঙালিকে জীবন হারাতে হয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল অসংখ্য মা-বোন। বিধ্বস্ত হয়েছিল রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরটি বাঙালির জাতীয় পথচলায় স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে অমর হয়ে আছে আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎলব্ধ স্বাধীনতার কারণে। সেই একাত্তর আজও ষোল কোটি বাঙালির প্রাণের প্রেরণায় পরিণত হতে পারে। ঘুণে ধরা এই স্বার্থভিত্তিক সমাজে যখন অপরকে সুখী করতে কেউ স্বশরীরে একটি ফুলের আঁচড় নিতেও রাজী নয়, যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির দিকে শকুণের ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি ফেলে রেখেছে, জাতির ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সন্ত্রাসীরা স্বজাতির নিরীহ মানুষগুলোকে আগুন দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে, তখন একাত্তরের সেই নিঃস্বার্থ চেতনা বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, জনমদুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য রক্তে শিহরণ জাগানো সেই ¯ে¬াগান আজ আবারও প্রাসঙ্গিক- মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি। বঙ্গবন্ধু ঠিক সেই সঠিক সময়ে বাঙ্গালি জাতিকে ডাক দিয়েছেন ৭ মার্চের ভাষণ এর মধ্য দিয়ে।


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ

ııভায়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি- কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা রাজশাহী রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।

আজ, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়- বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সংগে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

বাংলার মানুষ তারা আজ তার অধিকার চায়। নির্বাচনে আপনারা স¤পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।

১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম কওে রেখেেছ। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বলেলেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।

তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো-আমরা তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন।

আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।

জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়; আরো আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ও মুফতি মাহমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হলো- উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের স¤পদ।

কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ডবল জিম্মী হতে পারবেন না। পরিষদ কসাই খানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবে না। তা সত্বেও পয়ত্রিশ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্ত পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলো, বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে, বলা হলো আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি। এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো। কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুখি জনতার উপর চলছে গুলি।আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ই মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তাঁর সাথে টেলিফোন আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেণ্ট, ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরীব জনসাধারণকে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে । আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না। কিসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে? তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহবান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো- কিন্তু গুলী করে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলী খাই, দোষ আমাদের- আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের। ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্ত আমার দাবী সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসনো না। এ দাবী মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাব না। ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, মানুষের অধিকার চাই। প্রধান মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসীর কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো; মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। ট্রেন চলবে- তবে সেনাবাহিনী আনা-নেয়া করা যাবে না। করলে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না। সেক্রেটারীয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট জজকোর্ট সহ সরকারী, আধা-সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের ব্যাঙ্কগুলো দু-ঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবেন না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। তবে, সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন। এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি একটিও গুলী চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো-পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবেনা। গুলী চালালে আর ভাল হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবা না। বাঙ্গালী মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন। সাত দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি-শিল্প মালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এ দেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন, আন্দোলন কিভাবে করতে হয় আমি জানি। কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আন্তকহলের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোন বাঙ্গালী রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রস্তুত থাকবেন, ঠান্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃংখলা বজায় রাখুন। শৃংখলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা।”

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ এবং তৎকালীন পত্রিকার পাতা

শেষ ফালগুনের দুপুর। সেদিন ছিল না শীত না গরম। আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু চড়া রোদ সেদিন ছিল না। লেখক, প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ এভাবেই বর্ণনা করেছেন সেদিনের পরিবেশটাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। কিন্তু বেলা ১১টা বাজতেই জনসমুদ্র সেদিনের রেসকোর্স, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অগ্নিঝরা দিন ৭ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধু দেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলোতে এক লেখায় উল্লেখ করেন, তখন রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মওলানা ভাসানী রোড এখনকার মতো প্রশস্ত ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর দিকেও শতবর্ষী সেগুন ও মেঘশিরীষ ছিল কয়েকটি। উদ্যানটি ফাঁকা। সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। বেলা সাড়ে ১১টার সময় কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোড থেকে আমি গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র। কোনোরকমে আমি ঠাঁই পাই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকে এক গাছের তলায়, যে গাছের ডালেও বসেছিল কয়েকজন। জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টা খানেক দেরি হয়। প্রথাগত জনসভা নয়, একমাত্র বক্তা বঙ্গবন্ধু। জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। উচ্চারিত হয়: ভায়েরা আমার…। ৭ মার্চের ভাষণের খবর কেমন গুরুত্ব পেয়েছিল তখনকার সংবাদপত্রে? পরদিন ৮ মার্চ ২৩ ফালগুন সোমবার তখনকার অন্যতম প্রধান দৈনিক ইত্তেফাক খবরটি ছাপে ৮ কলাম ব্যানারে। শিরোনাম ছিল, পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি, যদি-। যদি চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। শিরোনামের নিচে উল্লেখ করা হয় সেই চার দাবি। ক. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয় খ. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় গ. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় ঘ. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

শিরোনামের নিচে দেওয়া হয় গর্জে ওঠা বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই ছবির ক্যাপশনটা ছিল, ….সামরিক বাহিনীকে অবিলম্বে ব্যারাকে ফিরাইয়া লও। খবরের পেটে আরেকটি শিরোনাম: আজ থেকে আমার নির্দেশ। খবরের নিচে আট কলামজুড়ে সমাবেশে উপস্থিত হর্ষোৎফুল্ল লাখো জনতার ছবি। ছবির ওপরে ক্যাপশন, এবার বন্দী বুঝেছে মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ, জয় নিপীড়িত জনগণ জয়, জয় নব উত্থান। এই সমাবেশের এক পৃষ্ঠা আলোকচিত্র ছাপা হয় ৬-এর পৃষ্ঠায়। চিত্রে রবিবারের রেসকোর্স নামে এ পাতায় ছবি ছিল সাতটি। প্রথম ছবিটি ছিল তখন স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি দোয়া কামনা বিষয়ে। একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতারা দুই হাত তুলে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন। একটি ছবি শুধু নারীদের। হাতে তাঁদের লাঠি ও বাঁশি। এতে ক্যাপশন লেখা হয়, মা-বোনেরাও আসিয়াছিলেন হাজারে, হাজারে। একটি ছবি বাসের সারির। ভেতরে, ছাদে উৎফুল্ল জনতা। এদিনের পত্রিকায় সাবহেড দিয়ে ভাষণের পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়। এ ছাড়া একাধিক পার্শ্বপ্রতিবেদন ছাপায় পত্রিকাটি।

তখনকার দিনের আরেকটি প্রধান দৈনিক সংবাদ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সংগত কারণে এ দৈনিকেও আট কলামজুড়ে ছাপা হয়। রিভার্স টাইপে শিরোনাম ছিল: এবার স্বাধীনতার সংগ্রামঃ মুজিব। খবরটিতে দুই লাইনের শোল্ডার ছিল: সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিব কি না ঠিক করিব। নিজস্ব বার্তা পরিবেশক পরিবেশিত খবরটির সূচনা ছিল বড় পয়েন্টে। মূল শিরোনামের নিচে বঙ্গবন্ধুর ট্রেডমার্ক ভার্টিকাল ছবি। ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দেন, তা মুজিবের নির্দেশ নামে পৃথক আরেকটি শিরোনামে ছাপা হয়। ভেতরে ছাপে শেখ মুজিবের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ। এই পাতাতেই জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ছবি। সংবাদে গতকালের রেসকোর্স ময়দান শিরোনামে এক কলাম একটি খবর ছাপা হয়। খবরের প্রথম দুটো অনুচ্ছেদ ছিল এ রকম: গতকাল রেসকোর্স ময়দান ছিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণির মুক্তিকামী মানুষের বিচিত্রময় সমাবেশে পূর্ণ।

ধানের দেশ, গানের দেশ, পানির দেশ, এই পূর্ব বাংলার ছাত্র, শ্রমিক-কৃষক, মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমার, কেরানি-পিয়ন, সকল স্তরের সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, মধ্যবিত্ত, নি¤œ-মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষের সেই সমাবেশে ধন-ধান্যে পু®েপ ভরা, সুজলা-সুফলা পূর্ব বাংলা যেন কালবৈশাখীর রুদ্ররূপে ফাটিয়া পড়ে রেসকোর্স ময়দানে। কণ্ঠে তাহাদের মুক্তির গান, বক্ষে তাহাদের স্বাধিকারের অগ্নি শপথ। রেসকোর্সে বিক্ষুব্ধরূপে যেন গোটা পূর্ব বাংলা উপস্থিত।
৭ মার্চের ভাষণঃ পটভূমি ও তাৎপর্য

আজ থেকে ৪৪ বছর আগে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিব ওই দিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ııএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

কী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৩টি মহিলা আসনসহ জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩টি (৩০০+১৩=৩১৩)। এর মধ্যে অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল- পূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা ছিল ১৬৯টি (১৬২+৭=১৬৯)। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। ওই নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সামরিক আইনের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসন পাওয়ার পর বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান। ৭১-এর পহেলা মার্চ ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)।

৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চলল। সারা দেশে তখন একজন মাত্র নেতা। তিনি হচ্ছেন দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। শেখ মুজিবের কথাই তখন আইন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে।

সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এল ৭ মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ মার্চের দিকে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী বলবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবিয়ে তুলল পাকিস্তান সামরিক চক্রকেও। কারণ তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা শেখ মুজিবের কথায়। এই অবস্থায় ৭ মার্চ শেখ মুজিব যদি রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। চিন্তিত পাকিস্তান সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ııউইটনেস টু সারেন্ডার” গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।

৭ মার্চের পূর্ব রাতে জে. ইয়াহিয়া টেলিপ্রিন্টারে শেখ মুজিবের কাছে একটি বার্তাও প্রেরণ করেন। সালিকের গ্রন্থে রয়েছে- একজন ব্রিগেডিয়ার জে. ইয়াহিয়ার সেই বার্তা ৭ মার্চের আগের রাতে শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন। মেজর সালিক ওই বার্তাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। বার্তায় জে. ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন, “অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি সহসাই ঢাকা আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে- যা আপনাকে আপনার ছয়দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।” (সূত্র : ııউইটনেস টু সারেন্ডার) ৬ মার্চ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা, টেলিপ্রিন্টারে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা প্রেরণ করেও পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না জে. ইয়াহিয়া। ৬ মার্চ এও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।

৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার বক্তব্য কী হবে- এ নিয়ে ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয়। জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী বলবেন- এ নিয়ে বিভিন্নজন বক্তব্য রাখেন। একপক্ষের মত, বঙ্গবন্ধু যেন জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অন্যপক্ষ স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা পরিহার করে আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষে মত প্রদান করেন। সভা ৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইলো। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য। যদ্দুর জানা যায়, ৭ মার্চ ভাষণ দেয়ার আগে চিন্তিত বঙ্গবন্ধুকে বেগম মুজিব বলেছিলেন, ııআল্লার নাম নিয়ে তোমার মন-দিল-অন্তর থেকে যা আসে- তাই বলে দিও।”

পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে ¯পষ্ট জানিয়ে দেন, “পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।”

এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন- আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।”

প্রকৃতপক্ষে ৭১-এর পহেলা মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয়। যে জন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানি শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে জন্য তিনি ঘোষণা করেন, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকে- ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন। তা ছাড়া ভাতে মারবো, পানিতে মারবো- এ কথার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করার কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সময় এমন ছিল যে, কোনো কোনো বিদেশি পত্রিকাও তখন জানিয়েছিল- ৭ মার্চ শেখ মুজিব হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ৭১-এর ৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার এবং ৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ ৭১ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয় “শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭১-এর ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন? জবাবে শেখ মুজিব বলেন, আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার। ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত? শেখ মুজিব উত্তর দেন, বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ইতিহাস প্রমাণ করে- ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বঙ্গবন্ধু শতভাগ সঠিক কাজটিই করেছেন। ২০০৬ সালের ৩১ মার্চ আইয়ুব খান নামের একজন কলাম লেখক দৈনিক ভোরের কাগজে যথার্থই লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি শব্দ বা দাড়ি-কমাতেও বাহুল্য ছিল না। প্রতিটি শব্দ বা বাক্য বাস্তবতার গভীর থেকে উৎসারিত। এ যেন কোনো দেবদূত, সমবেত জনতাকে তাদের সংকটকালে অমোঘ নিয়তির দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।

উল্লেখ্য, ওই ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার মাধ্যমে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাকি প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান। মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় এনেছিল।

ıı৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও অস্তিত্ব”- সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও অস্তিত্ব। এ ভাষণের প্রতিটি বাক্য এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। ভাষণটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, এটি শুধু একটি ভাষণই না, এটি বাঙালি জাতিসহ সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের দর্শন। বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের অবলম্বন এবং অনুপ্রেরণা। অথচ ৭৫-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রেত্বারা বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তারা ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে এটাই আজ প্রমাণ হয়েছে- ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে।

¯িপকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার রাতে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে আনীত একটি ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে সংস্থাটির ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ইউনেস্কোসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ সরকার ও বিরোধী দলের ৫৭ জন সংসদ সদস্য বক্তব্য রাখেন। আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িত। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত হয়েছিল। বাঙালি জাতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মার যে গভীর একাত্বা ছিল এই ভাষণে মর্মে মর্মে সেটি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। মাতৃভাষার অধিকার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ছিল চরম মুহূর্ত। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতারই ঘোষণা দেননি, বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের কথাও বলেছিলেন। একটা জাতিকে কীভাবে গড়ে তোলা হবে, তার সবকিছুই বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন বাঙালি জাতির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলন এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতে কী কী করতে হবে সে নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানের শাসকরা তাকে হয়তো আর কথা বলতে নাও দিতে পারে, সেজন্যই বলেছিলেন আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি বাক্য এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, অর্থনৈতিক মুক্তির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী তা হতে দেয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো বন্ধ করে দিয়েছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা ওই সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মনে হচ্ছিল পাকিস্তানের প্রেত্বারা এসে দেশ চালাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম, নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল, ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরবে- আজকে এটিই প্রমাণ হয়েছে।

সংসদ নেতা বলেন, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যে, সে দেশে একটি ভাষণ ৪৬ বছর ধরেই মানুষ শুনে যাচ্ছেন। যা এখনও এতটুকু পুরনো হয়নি, আবেদন হারায়নি। বরং মানুষ এই ভাষণ শুনে নতুন করে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। সারা দেশে এখনও সমান মহিমা নিয়ে ভাষণটি বেজে চলেছে। কত হাজার বার বেজেছে সেই হিসাব করাও কঠিন। তিনি বলেন, আড়াই হাজার বছর ধরে যে ভাষণগুলো জাতিকে উজ্জীবিত করেছে, পৃথিবীর তেমন একশটি ভাষণের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে।

ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এই ভাষণটিই ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরকেও ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বাজানো হতো এই ভাষণ।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী বক্তব্যের পেছনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ দেয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে অনেক নেতা অনেক কথা বলেছেন। অনেকে অনেক কিছু লিখেও দিয়েছেন। জনসভায় যাওয়ার আগে আমার মা (বেগম মুজিব) বাবাকে (বঙ্গবন্ধু) ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন কিছু সময় রেস্ট নাও, তোমার সামনে অনেক দায়িত্ব। অনেকে অনেক কথা বলবে। এ দেশের মানুষের কিসে ভালো হবে তোমার থেকে কেউ বেশি জানে না। জনগণের হাতে বাঁশের লাঠি, আর হানাদারদের হাতে বন্দুকের নল। লাখো মানুষের জীবন তোমার হাতে। তাই কারোর কথা শোনার দরকার নেই। তোমার মনে যা আসবে সেটিই তুমি বলবে। ৭ মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনো লিখিত বা পয়েন্ট ছিল না। তিনি অলিখিত এই কালজয়ী ভাষণ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আবেদন যুব সমাজের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিল। প্রতি বছর ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে একটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হচ্ছে। ওইসব বক্তব্য দিয়ে বই প্রকাশ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এই ভাষণের মূল্য অনেকেই বুঝতে পারবে না। যারা বুঝতে চায় না তারা তো ভাষণটি মুছে ফেলারই চেষ্টা করেছিল।

তিনি বলেন, ভাষণটি আজ ১২ ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির গর্ব, সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলব। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

৭ই মার্চের ভাষণঃ ঐতিহাসিকতা

একটি জাতির ক্রান্তিলগ্নে একজন দক্ষ কান্ডারির সঠিক দিক-নির্দেশনাই পারে জাতিকে ক্রান্তিকাল থেকে উদয়ের পথে নিয়ে যেতে। যেরূপ পেরেছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে না হলে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হতে পারতো কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ । বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য মূল তার ৭ মার্চের ভাষণে একটি পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। জাতির উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অনন্ত মহিমায় ভাস্কর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা সৃষ্টিকারী ভাষণগুলোর অন্যতম ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙলার হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষের মর্যাদা নিয়ে বিশ্বসভায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আকাক্ষা মূর্ত হয়েছে এই ভাষণে। গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালে প্রদত্ত বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনীয়, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির উদ্দেশ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক-নির্দেশনামূলক ৭ মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তদানের গৌরবময় ইতিহাস। উদার মন ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশবাসী তার একান্ত আপনজন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল জনসভায় সমবেত মুক্তিপাগল দেশবাসীকে ভাইয়েরা আমার বলে তিনি সম্বোধন করেন। ভাষণের শুরুতে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন-“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়।” ১৯৭০সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে আরেক উদ্বেলিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, “নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ স¤পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে গড়ে তুলব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, গত ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাসৃ।” প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক তাৎপর্যে মন্ডিত। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে ১৯ নভেম্বর, ১৮৬৩ স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে জাতীয় সৈনিক সমাধিক্ষেত্র উৎসর্গকরণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের। গেটিসবার্গ এড্রেস’ খ্যাত ভাষণটি ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল, জনকল্যাণ করতে পারে “জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার, যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবে না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির বিষয়বস্তু আরো অনেক বেশি ব্যাপক। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন বস্ত্র, বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিয়শ্চয়তাসহ কূপমুন্ডকতা থেকে মুক্ত করার দিক নির্দেশনা সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ১০ মার্চের প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবিতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রভাবমুক্ত ও কর্তৃত্বমুক্ত থেকে পূর্ব বাংলা স্বাধীন সত্তা অর্জন করে এবং সকল কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাংলার মুকুটহীন রাজা। মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য এবং ঐতিহাসিকতা এতো ব্যাপক যে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণঃ মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব পরিমন্ডলে আরও একবার বাংলাদেশের জন্য অবিস্মরণীয় মর্যাদা এনে দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বাংলাভাষা, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতিকে সীমাহীন ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, মৃত্যুর পরেও সেই দেশের উন্নতি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে তিনি অবদান রাখছেন।

সোমবার (৩০ অক্টোবর, ২০১৭) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক ঘোষণায় এ কথা জানান। এই তালিকায় ঠাঁই পায় বিশ্বের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর, ২০১৭) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইউনেস্কোর ıমেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকার মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে। বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত ıমেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে প্রভাব থাকতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলি বলেছেন, ıএখন সারাবিশ্ব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স¤পর্কে জানতে পারবে। এই ভাষণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রেরণা। এই ভাষণেই জেগে উঠেছিল পুরো জাতি।’ তিনি আরও বলেন, ıএই ভাষণে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায় বাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যায়।’ আন্তর্জাতিক অ্যাডভাইজরি কমিটি এই তালিকার প্রস্তাব দিয়ে থাকে। তারাই যাচাই বাছাই করে থাকে পুরো প্রক্রিয়া। চলতি বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে বৈঠকে বসে কমিটি। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ৭ মার্চের ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করার। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের মোট ৪২৭টি নথি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয়েছে।

৪৬ বছর আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

ইউনেস্কো জানিয়েছে, তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ)কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি গত ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর প্যারিসে দ্বিবার্ষিক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে এবার ıডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ıমেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ দেয়। এরপর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ওই সুপারিশ সম্মতি দিয়ে বিষয়টি ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেন এবং সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য প্রকাশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশে মহাপরিচালকের সম্মতি পেলেই কোনো দলিলকে ওই তালিকায় যুক্ত করে নেওয়া হয় এবং পরে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ıডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হলো সেই সব নথি বা প্রামাণ্য দলিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে। আর সেসব ঐতিহ্যের তালিকা হলো ıমেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’। এসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে, সেজন্যই ১৯৯২ সালে একমসূচি শুরু করে ইউনেস্কো। এতদিন এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ৪২৭টি নথি ও প্রামাণ্য দলিল ছিল।

কোনো দলিল বা নথি এই তালিকায় স্থান পাবে তা পরীক্ষা ও মূল্যায়নের দায়িত্ব রয়েছে ১৫ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত এমডব্লিউ কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আলরাইজি বর্তমানে এর চেয়ারম্যান। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আসা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ৭৮টিকে এবার ıমেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশে সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়ে ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা বলেন, ıআমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এসব স্মৃতি ও দলিল সংরক্ষণের এ কর্মসূচি এমনভাবে পরিচালিত হওয়া ইচিত, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোচনা, সহযোগিতা, পার¯পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।

আর ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার খবরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, ıএকাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণার উৎস।’ ııআজও দেশে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে মাইকে বাজতে শোনা যায়। আজও সেই ভাষণ বাঙালির হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখনও যেভাবে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে, আগামী প্রজন্মকেও একইভাবে অনুপ্রেরণা জোগাবে।”

৭ মার্চের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানঃ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল ময়দান। মহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজের অসংখ্য পতাকা।

তার মঞ্চে আসার কথা ছিল বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে, তবে কিছু বিলম্বে বিকেল ৩টা ২০মিনিটে তিনি উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। তখন তার পরনে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে।

তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি বলে চলেন, ı… আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ı…সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন, এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন তার চূড়ান্ত আদেশ- ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব-এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মাত্র ১৯ মিনিটের সেই অবিস্মরণীয় ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সম্প্রচার কার্যক্রম। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ইউনেস্কো মহাপরিচালক মিস ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই স্বীকৃতির ফলে এ ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) রেজিস্টার নিবন্ধিত হলো। এমওডব্লিউতে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নাহিদ ইউনেস্কো সদর দপ্তর প্যারিস থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তাকে অভিনন্দন জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধারাবাহিক সমর্থন দেয়ার জন্য ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মিস ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি ইউনেস্কো সাধারণ সম্মেলনে অংশগ্রহণরত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যদেরও ধন্যবাদ জানান। মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ বর্তমানে ডকুমেন্ট ও সংগ্রহ দাঁড়াল ৪২৭টি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিসে ৩৯তম সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং গত সোমবার ৩০ অক্টোবর তিনি চলমান সাধারণ সম্মেলনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

তিনি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিলেন, এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রবল বিরোধী হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার বিচার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠনের জন্য তাকে আহ্বান জানানো হয় নাই। এই প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধু প্রথমে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। এ সময় থেকেই পাকিস্তান সরকারের কোনো আইন (পূর্ব) বাঙালিরা মানত না। এর পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশ দ্বারা ১৯৭০-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হতো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসাধারণকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক ক্যারিসমেটিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর যা কিছু অর্জন তার সব কিছু প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের অর্জন। গবেষকগণ বঙ্গবন্ধুকে একজন যতœশীল পিতা এবং একজন সহমর্মিতাপূর্ণ রাজনৈতিক সঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের মতো বিশাল ও সুউচ্চতার মর্যাদা দিয়েছেন। একজন ছাত্রনেতা থেকে পূর্ব বাংলায় ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। মানবতা ও বাংলাদেশের শত্রু পক্ষ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করতে পারলেও, বাঙালির মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি এবং হবেও না। প্রসঙ্গক্রমে প্রাচীন এথেনীয় গণতন্ত্রেও নেতা পেরিক্লেসের কথা উল্লেখ করা যায়। এথেন্সের স্বর্ণযুগে পেরিক্লেস (৪৯৫-৪২৯ খ্রি.পূর্ব, যার নামের অর্থ হচ্ছে গৌরব দ্বারা আবৃত) ছিলেন এথেন্সের একজন রাষ্ট্র নায়ক, বিখ্যাত বাগ্মী, এবং সেনাপতি। তার প্রভাব এত গভীর ছিল যে সময়ে তিনি এথেন্স শাসন করতেন সেই যুগকে বলা হতো ‘পেরিক্লিসের যুগ’। বলা বাহুল্য, পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর তার এই প্রভাব থাকেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, জীবিত মুজিব থেকে মৃত মুজিব আরও বেশি শক্তিশালী। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর এথেন্স একটার পর একটা ভুল করতে থাকে। এসব ভুলের অন্যতম একটি হচ্ছে সর্বকালের সর্বজ্ঞানী সক্রেটিসকে বিষপানে মৃত্যুদন্ডের আদেশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে এবং পাকিস্তানিকরণ শুরু হয়। কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদাহরণ হিসেবে বিশ্ববাসী লক্ষ্য করছে।

যেভাবে রেকর্ড হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, রমনার রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে আহুত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল নেতা, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণটি প্রদান করেছিলেন, তা শুধু ভাষণ হিসেবেই অনন্য বা অসাধারণ ছিল না, জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফসল স্বাধীনতা লাভেও অপরিসীম ভূমিকা রেখেছিল। পৃথিবীর কোনো জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন বিস্ময়কর নজির সৃষ্টি হয়নি, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঘটেছিল। এই ভাষণটি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়েই নেয়নি, প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাও বহন করেছে। ফলে ২৫ মার্চ আক্রমণকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে জনগণ ৭ মার্চের ভাষণে উচ্চারিত স্বাধীনতার ঘোষণাকেই চূড়ান্তভাবে ধরে নেয়, প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চের তারবার্তাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আনুষ্ঠানিক ঘোষণারই প্রতিধ্বনি মাত্র। ১০ এপ্রিল নবগঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃত করেছে, দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক নিয়ম-নিষ্ঠতা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ৭ মার্চ উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাই প্রতিদিন প্রচার করেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই চলেছিল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন পর্যন্ত।

মনে রাখতে হবে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ব্যাপক কোনো প্রস্তুতি নিয়ে অভিও-ভিডিও করা যায়নি। যতটুকুও করা গেছে ততটুকুকেও সমন্বিতভাবে প্রচার বা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে সরাসরি প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপে তা সেদিন প্রচারিত হতে পারেনি। এর চিত্রায়ণও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ ধরণের ভাষণ ধারণ করার মতো প্রযুক্তিও তখন তেমন বিশেষ ছিল না। যা ছিল তা বেশ ভারি ও আয়তনসমৃদ্ধ ছিল। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলবেন, তাও আগে থেকে নির্ধারিত বা ঘোষিত ছিল না। তবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন, দিক নির্দেশনা দেবেন এমন আভাস ছিল, ধারণা ছিল। দেশি-বিদেশি মিডিয়াগুলো সভাস্থলে তাই আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। তখন অবশ্য আজকের মতো ভিডিও ক্যামেরা তেমন ছিল না। ফটো সাংবাদিক এবং রিপোর্টাররা ছবি এবং সংবাদ সংগ্রহ করতেন। তেমন পরিস্থিতিতে কথা ছিল বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সরাসরি প্রচার করবে। তাদের সে ধরণের প্রস্তুতি ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন পাকিসাতান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ। তারা আগেই সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক ভাষণের রেকর্ডিং করতে হবে। একই সঙ্গে দৃঢ় ছিলেন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের (ডিএফপি) কর্মকর্তা (পরে অভিনয়শিল্পী হিসেবে খ্যাত) মরহুম আবুল খায়ের। তিনি সচল ক্যামেরা বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের গোলাপগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমএনএ ছিলেন, তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ফিল্ম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ıজয় বাংলা’ ফিচার ফিল্মের তিনি প্রযোজকও ছিলেন। তার সঙ্গে তখন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ছিলেন এনএইচ খন্দকার। সিদ্ধান্ত হয় যে আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে এনএইচ খন্দকার মঞ্চের নিচে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে বক্তৃতা ধারণ করবেন। ডিএফপি কর্মকর্তা আবুল খায়ের মঞ্চের এক পাশে সচল ক্যামেরা নিয়ে চিত্র ধারণ করতে থাকেন। ক্যামেরার আকার বড় থাকায় খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে তিনি পারছিলেন না। বিশেষত ভাষণের পরিবেশ শুরু থেকে শেষ অবধি এতটাই আবেগ, উত্তেজনা ও দৃষ্টিকাড়া ছিল যে কোনো ক্যামেরাম্যানের পক্ষেই নড়াচড়া করার তেমন সুযোগ ছিল না। সে কারণে তিনি একটা দূরত্বে থেকে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার দৃশ্য যতটুকু পেয়েছেন ততটুকুই ধারণ করেছেন। ফলে দেখা যায় বক্তৃতার ভিডিও দৃশ্যটি ১০ মিনিটের। অন্যদিকে আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে মঞ্চের নিচে এ এইচ খন্দকার স¤পূর্ণ ভাষণের কথাই রেকর্ড করতে সক্ষম হলেন। বেতারের কর্মকর্তারাও ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারলেও এটির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড করাতে তাঁরা সক্ষম হন, যা পরদিন বেতারকর্মী এবং জনগণের দাবির কারণে বেতার থেকে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এইচএম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাষণটির একটি রেকর্ড প্রকাশের ব্যবস্থা দ্রুত স¤পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণের একটি রেকর্ড নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন। তিনি এর একটি কপি উপহার দিলে বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ıতুই এত বড় কাজ কিভাবে করলি?’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন তরুণ আরেক এমএনএ তোফায়েল আহমেদ ছিলেন। তিনি খায়ের সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন, খায়ের ভাই, এই রেকর্ড বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবেন, এর রয়ালটি তো আওয়ামী লীগও পেতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ ভাষায় মজা করে বললেন, ıগলা আমার, ভাষণ-আমার, রয়ালিটি পেলে তো আমাকেই দিতে হবে।’

এর পর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ভাষণের ৫০০টি রেকর্ড ৪৮, ইন্দিরা রোডস্থ অফিসের নিচে বস্তায় যতœ সহকারে মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। কয়েকটি রেকর্ড কলকাতায় পাঠানোরও ব্যবস্থা করা হয়। হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) কো¤পানি রেকর্ডটি এপ্রিল মাসে পায়। তারা এর তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি তখন বহির্বিশ্বে বিতরণের ব্যবস্থা করে। ঢাকা থেকে রেকর্ডটি ıঢাকা রেকর্ড’ নামে প্রকাশিত হয়। এই রেকর্ডে ভাষণটি যৎসামান্য স¤পাদনা করা হয়, যে সব বক্তব্য ভাষণে দুবার উচ্চারিত হয়েছিল, তা একবার রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটি দুবার উচ্চারিত হয়েছিল। ıঢাকা রেকর্ড’ তা একবার রেখেছিল। অন্যদিকে ঢাকা বেতার তা অটুটু রেখেছিল। তবে ঢাকা বেতারের কপিটি নানা বাধা-নিষেধের কারণে বাইরে প্রচারে তেমন আসতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা রেকর্ডটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং স্বাধীনতার পর নানাভাবেই প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পায়। এটি তাই সর্বাধিক প্রচারিত অভিও ভাষণ। ¯পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মাত্র দুটো প্রতিষ্ঠান রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে এর সচল দৃশ্য ধারণ করেছিলেন মাত্র একজন, তিনি অভিনয়শিল্পী মরহুম আবুল খায়ের। দেশি-বিদেশি কোনো সাংবাদিক হয়তো ভাষণের খন্ডিত কিছু অংশই ধারণ করেছিলেন। ফলে ভিডিওতে ভাষণের অতিরিক্ত দৃশ্য খুঁজে পাওয়া বেশ দুঃসাধ্যের ব্যাপার। সেটি সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। প্রয়োজন ছিল ঢাকা রেকর্ড এবং বেতারের রেকর্ড থেকে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ ভাষণটির একটি প্রামাণিকরণ। আবুল খায়ের এমএনএ এখনো বেঁচে আছেন। তিনি যমুনা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল তাঁর পুত্র। অভিনেতা আবুল খায়ের অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই আবুল খায়ের, সালাহউদ্দিন এবং এন এইচ খন্দকারের মতো মানুষ না থাকলে ১৯৭১ সালে আমরা হয়তো ইতিহাসের এমন মহামূল্যবান স¤পদ পেতামই না। তাদের আমাদের স্যালুট।

বঙ্গবন্ধুর এমন ঐতিহাসিক ভাষণটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে মুদ্রিত হয়েছে। এমন একটি ভাষণ এভাবে মুদ্রিত হওয়া মোটেও প্রত্যাশিত নয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা, যে কমিটি ভাষণটির টেপ বা রেকর্ড ও মুদ্রিত সামগ্রী যাচাই-বাছাই করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দেবে; যা ভাষণটির প্রকৃত আকারটি ধারণ করবে। লক্ষ করলে দেখা যায়, হাসান হাফিজুর রহমান স¤পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয় খন্ডের পৃষ্ঠা ৭০৩-৭০৫-এ যে ভাষণটি স্থান পেয়েছে তা সূত্র হিসেবে ıজয় বাংলা’ বিশেষ সংখ্যা এবং টেপ রেকর্ড থেকে লিপিবদ্ধ বলে লেখা থাকলেও সেটি প্রামাণিকরণ হয়েছে বলে মনে হয় না। আরো কিছু গ্রন্থেও ভাষণটির মুদ্রিত রূপ স্থান পেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অমিল চোখে পড়ে, যা মোটেও কাম্য নয়। আসলে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে এটিকে দেখা ও ব্যবহার করা। এর অডিও, ভিডিও এবং মুদ্রিত উপাদান অভিন্ন হতে হবে, একাত্তরের আদি উৎসে যাওয়ার ও পাওয়ার চেষ্টা সমাপ্ত করতে হবে, এর পর এর একটি রাষ্ট্রীয় দালিলিক মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। বাজারে এর খন্ডিত সামগ্রীগুলো তা হলেই কেবল বিদায় নিতে বাধ্য হবে। এখন আমাদের অজান্তে ও অলক্ষে যৎসামান্য হলেও বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণাঙ্গ ভাষণই আমরা বহন করে চলেছি। আশা করি, সরকারই যথা শিগগির যথাযথ উদ্যোগ নেবে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণঃ সংবিধানের ভিত্তি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক প্রামাণিক দলিল হিসেবে পরিগণিত যাকে অতিসম্প্রতি ıমেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো তার ıমেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর স্বীকৃতি প্রদান কর্মসূচী শুরু করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিলসমূহকে মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই ধারাবাহিকতায় আজ অবধি গোটা বিশ্বে মোট ৪২৭টি প্রামাণিক দলিলকে ıমেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এই ৪২৭টি প্রামাণিক দলিলের মধ্যে অলিখিত ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি। বাঙালি জাতির জন্য কী অনবদ্য এক অর্জন!

ইউনেস্কো তার ওয়েব পেজে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স¤পর্কে বর্ণনা করেছেঃ
ııঞযব ংঢ়ববপয বভভবপঃরাবষু ফবপষধৎবফ ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয. ঞযব ংঢ়ববপয পড়হংঃরঃঁঃবং ধ ভধরঃযভঁষ ফড়পঁসবহঃধঃরড়হ ড়ভ যড়ি ঃযব ভধরষঁৎব ড়ভ ঢ়ড়ংঃ-পড়ষড়হরধষ হধঃরড়হ-ংঃধঃবং ঃড় ফবাবষড়ঢ় রহপষঁংরাব, ফবসড়পৎধঃরপ ংড়পরবঃু ধষরবহধঃবং ঃযবরৎ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ নবষড়হমরহম ঃড় ফরভভবৎবহঃ বঃযহরপ, পঁষঃঁৎধষ, ষরহমঁরংঃরপ ড়ৎ ৎবষরমরড়ঁং মৎড়ঁঢ়ং. ঞযব ংঢ়ববপয ধিং বীঃবসঢ়ড়ৎব ধহফ ঃযবৎব ধিং হড় ৎিরঃঃবহ ংপৎরঢ়ঃ. ’’

অর্থাৎ ইউনেস্কোর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কার্যকর অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। এই ভাষণ গোটা বিশ্বের উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের সর্বজনীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার এক অকাট্য প্রামাণিক দলিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল একটি উপস্থিত-বক্তৃতা অর্থাৎ ভাষণটির কোনো লিখিত রূপ ছিল না।

জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সু¯পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বাঙালি জাতির উপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন।

একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর বক্তব্যে একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরিব মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন।

সবশেষে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবার কথাই বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত বিশ্বের আর কোনো নেতা পারেননি। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে সু¯পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন,“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা স¤পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।” অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সমাজতন্ত্রকে ধারণ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ভাবনা শাস্ত্রীয় সমাজতন্ত্র ছিল না। আমরা পরবর্তীতে তাঁর অনেক বক্তৃতায় সে ব্যাখ্যা পেয়েছি। তিনি সমাজতন্ত্রকে তত্ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে শোষণহীন, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি জানানো হয়েছে, শোষণমুক্ত সমাজের দাবি জানানো হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখানে শ্রমজীবী মানুষের উপর তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তাঁর ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন,“গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।” পাহাড়সম প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু গরিব দুখী ও শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। যদি তৎকালীন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিজয় আমরা দেখতেই পেতাম তাহলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আর প্রয়োজনই হত না। স¤পূর্ণ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায্য দাবি জানিয়েছেন। তিনি যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। আবার এটাও সত্য যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকশিত রূপ ধারণ করেছেন। গণতন্ত্রের সংখ্যাগত প্রেক্ষিত নয়, বরং তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গণতন্ত্রের গুণগত মান। ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন,“আমি বললাম অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব– এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।”

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন,“এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।” এই বাক্যটি ıধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতির বহিপ্রকাশের একটি অনন্য উদাহরণ। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল সেটি যে একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল তার বড় প্রমাণ হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। বাংলাদেশ জন্মের অন্যতম মূল উদ্দেশই ছিল ধর্মনিরেপেক্ষ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যদিও বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বে প্রদান করা হয়েছিল তথাপি ৭ মার্চের ভাষণের যে ভাষা তার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রূপকার হিসেবে দেখতে পাই।

আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সংবিধানের পঞ্চম তফসিল দ্বারা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু, সংবিধানের ৭(খ) অনুযায়ী সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের একটি অপরিবর্তনযোগ্য বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে পঞ্চম তফসিলে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি আমাদের সংবিধানের একটি অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় অংশে পরিণত হয়েছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রের মূল পাঠকে সংবিধানের সঙ্গে সংযোজিত করেছে মাত্র। কিন্তু যেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই সেটা হল, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান থেকেই এই দুটি বিষয় আমাদের সংবিধানের অন্তর্গত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র দুটি আমাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলেও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে চিহ্নিত করে সংবিধানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে সু¯পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক।

একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। সুতরাং এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলের যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগিরা। ১৯৭১এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীনতার সংগ্রামে। এই ভাষণ ছিল আমাদের সেই সময়ে দিশেহারা জাতির জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ।

আর আজকে এই ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির একান্ত ঐশ্বর্য নয়, বরং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বমানবতার ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো কর্তৃক ıবিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের’ অন্তর্গত করার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার বিজয় প্রতিষ্ঠিত হল। এগিয়ে যাক বিশ্বসভ্যতা, বিশ্ব মানবতা।

উপসংহার
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর একাধিক ভাষায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে (৪৬ বছর) পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো নেতার ভাষণ সেদেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে কিনা সন্দেহ। এটি এমনই ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই মনে হবে এই প্রথমবার শোনা হল, কখনও পুরনো মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা স¤পদ। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী- সবার জন্যই এ ভাষণে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

লেখক: মোঃ হাবিবুর রহমান, সহকারি অধ্যাপক, (গবেষক: আইবিএস, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়) ও জোবেদা নাসরীন, সহকারি অধ্যাপক, বাংলা


Logo

Website Design & Developed By MD Fahim Haque - Web Solution