মাহবুবুল ইসলাম সুমন, দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পরও সংরক্ষণ করা হয়নি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে থাকা গণকবর। গণকবরটি সংরক্ষণ না করায় হারাতে বসেছে গণশহীদদের স্মৃতি। প্রজন্মের কাছে পাক হানাদারদের নির্মমতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাসের জানান দিতে গণকবরটি সংরক্ষণের দাবী স্থানীয়দের। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার-ডেপুটি কমান্ডার জানেন না সোনারগাঁয়ে থাকা গণকবরের কথা।
সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউপির পিরোজপুর গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। যুদ্ধের সময় হানাদারেরা গ্রামটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি চালায় গণহত্যা। পিরোজপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আব্বাস আলী মেম্বার, তাজুল ইসলাম মোল্লা, মুক্তিযোদ্ধা (নন গেজেটেড) ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফিরোজ্জামান মোল্লাসহ আরো অনেকে জানান, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ রোববার দুপুরের দিকে পাক হানাদার বাহিনীর দুইজন সিপাহী গ্র্যান্ডট্র্যাঙ্ক রোডের মোগরাপাড়া বাজারে যায় চুল-দাড়ি কাটার জন্য। এসময় নাপতা (সেলুন) দোকানের বাইরে রাস্তায় সেই দুই পাকসেনার সামনা সামনি পড়ে যায় কান্দারগাঁও গ্রামের যুবক বরজাহান মিয়া। তিনি পাকসেনাদের দেখেই উত্তেজিত হয়ে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাঁচা মরার কথা ভুলে গিয়ে তাদের উপর হামলে পড়ে। একাই দুজনের সাথে ধস্তাধস্তি করে তাদের কাছে থাকা রাইফেল ছিনিয়ে সেই রাইফেলের বাট দিয়েই তাদের পিটিয়ে আধামরা করে রাস্তায় ফেলে দৌড়ে মারীখালী খাল পাড়ি দিয়ে পিরোজপুর গ্রাম হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এদিকে খবর পেয়ে আরো পাকসেনারা এসে বরজাহান মিয়ার সন্ধান করলে আহত পাকসেনারা পিরোজপুর গ্রাম দেখিয়ে দেয়। পরবর্তিতে পাকসেনারা পিরোজপুর গ্রামের পশ্চিম দিক থেকে হানা দিয়ে আলাউদ্দিন হাজীর বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে বাড়ি বাড়ি গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয়। দেড় শতাধীক বাড়ি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি টহল চলতে থাকে মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে। এদিকে আত্মরক্ষার্থে এই গ্রামের “আয়েত আলী ফকির, নুরুল হক মোল্লা, আঃ রহমান ও সাইদুল হক” গ্রামেরই অসুস্থ কিশোরী রিজিয়া ওরফে রেজী’কে খাঁটিয়ায় করে দৌড়ে নিয়ে যেতে থাকে। এসময় তারা গ্রাম সংলগ্ন তাজুল ইসলাম মোল্লার জমিনের কিনারা ও বালুয়া খালের পাড়ে যাওয়ামাত্রই হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে এলোপাতারি ব্রাশফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলেই শাহাদৎ বরণ করেন “আয়েত আলী ফকির, নুরুল হক মোল্লা, আঃ রহমান ও সাইদুল হক। তার অদুরেই গুলি করে শহীদ করা হয় আবু প্রধানকে”। পাকসেনারা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে যাওয়ার পর সেই বালুয়া খাল পাড় হয়ে আত্মগোপনে যাচ্ছিলেন আব্বাস আলী মেম্বার। সেসময় তিনি দেখেন লাশের কিনারায় পড়ে থেকে অসুস্থ রেজী অস্পষ্টভাবে কাঁতর সুরে পানি পানি বলে গোঙরাচ্ছে। তিনি রেজীকে পানি পান করিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। রাত হয়ে যাওয়ায় পাকবাহিনীর ভয়ে গ্রামবাসী তাদের দাফন করতে পারেনি। পরদিন তাড়াহুড়ো করে যেখানে লাশগুলো পড়েছিল সেখানে খালের পাড়েই জানাজা ছাড়া শাহাদৎবরণকারী “আয়েত আলী ফকির, নুরুল হক মোল্লা, আঃ রহমান ও সাইদুল হক’র মরদেহগুলো একত্রিত করে গণকবর দেয় গ্রামের অল্পকিছু মানুষ। আর পৃথক স্থানে মাটি দেন আবু প্রধানকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই গণকবরটি সরকারি বা ব্যাক্তি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়নি। অথচ এমন গণকবরগুলো মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহণ করে। এই গণকবরটি সংরক্ষণ না করায় হারাতে বসেছে সোনারগাঁয়ের গণশহীদদের স্মৃতি। স্বাধীনতার দীর্ঘকালেও গণকবরটি সংরক্ষিত না হওয়ায় তাদের নামচিহ্ন একেবারেই যখন হারিয়ে যেতে বসেছে তখন সেই গণশহীদদের অন্তত নাম পরিচয়টুকু একটি সাইনবোর্ডে লিখে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন ফিরোজ্জামান মোল্লা। তিনি সম্প্রতি গণশহীদদের নাম ঠিকানা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পিরোজপুর গ্রামে প্রবেশ মুখে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সোহেল রানা ও ডেপুটি কমান্ডার ওসমান গণি জানেনই না সোনারগাঁয়ের গণকবরটি কোথায়। ডেপুটি কমান্ডার ওসমান গণি প্রথমে সোনারগাঁয়ে গণশহীদদের কথা অস্বীকার করলেও পরে ৩ জনের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তাদের গণকবরটি কোথায় দেয়া হয়েছে তা তিনি জানেন না বলে স্বীকার করেন। এদিকে স্থানীয়রা আরো জানান, পরের প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে বা জানাতে উদ্যোগী হবেন, তাদের জন্য এসব গণকবর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই এসব গণকবর সংরক্ষণ করা জরুরি। গণকবর শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ সম্ভব হবে। তাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতার ইতিহাস পরিচয় করিয়ে দিতে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ অতিব প্রয়োজন।