ঘড়িতে তখন সকাল ৯টা। রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট থেকে দৈনিক বাংলার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোলাইমান হোসেন। একই সময়ে তার অপর সহকর্মী ইকবাল উদ্দিন একটি লেগুনায় ওঠেন। সোলায়মান হোসেন কর্মস্থলে পৌঁছে গেলেও ইকবালের লেগুনাটি তখনও ফকিরাপুল মোড়ে যানজটে আটকা রয়েছে।
সোলায়মান হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘একদিন-দুই দিন নয়, সপ্তাহের ছুটির দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই অফিস সময়ে এমন যানজট থাকে। তাইলে এখন আর যাতায়াতে যানবাহনের ওপর ভরসা করি না। হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করি।’
একই সময়ে নগরীর মগবাজার মৌচাক উড়াল সেতুর মৌচাক অংশে যানজটে কয়েকশ’ গাড়ি আটকে থাকতে দেখা গেছে। এই গাড়িগুলোর একটির যাত্রী তানভীর উদ্দিন। অসহ্য হয়ে বাস থেকে নেমে বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেন দৃষ্টি যতদূর পড়ে ততদূর যানজট। আরও কিছু সময় অপেক্ষা করে মালিবাগ পৌঁছার পর বিরক্তি নিয়ে বাস থেকে নেমে গন্তব্যে হাঁটা শুরু করেন।
কাকরাইল মোড়ে যাত্রী নামিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে সড়কের ভয়াবহ যানজটের কথা বর্ণনা করেছন পাঠাও চালক গিয়াসউদ্দিন। রামপুরা ব্রিজ থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৫৫ মিনিট। তাকে সমর্থন জানিয়ে যাত্রী আমির হোসেন বলেন, যদি সম্ভব হতো মোটরসাইকেল থেকে নেমে হেঁটে যাত্রা শুরু করতাম। পায়ে ব্যথার কারণে যানবাহন ছাড়া চলাচলের উপায় নেই তার।
ইকবাল উদ্দিন, তানভীর উদ্দিন বা গিয়াস উদ্দিনের মতো প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যানজটে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অফিস বা কাজের উদ্দেশে প্রতিদিনই অতিরিক্ত সময় নিয়ে বের হতে হয়। নগরীতে যানজটের ঘটনা পুরনো হলেও অনেক দিন পর গত কয়েক দিন হঠাৎ যানজটের এই মাত্রা তীব্র হয়ে উঠেছে। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি।
সরেজমিনে ঢাকার দৈনিক বাংলা, কাকরাইল, পল্টন, মালিবাগ, ফকিরাপুল, মতিঝিল, গুলিস্তান, আজিমপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, রামপুরা, মগবাজার, শান্তিনগর, বিমানবন্দর সড়কসহ বেশ কিছু এলাকার প্রধান সড়ক ঘুরে যানজটের প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায়।
যানজটের এমন চিত্রের জন্য রিকশাসহ ধীরগতির যানবাহন ও যানবাহনের রেজিস্ট্রেশনকে দায়ী করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে সড়ক বন্ধ থাকা, মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত গাড়ি, গাড়ি চলাচলের পথ ছোট হয়ে আসা এবং সড়কে মাত্রাতিরিক্ত মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়াকেও দায়ী করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিমাত্রার যানজটের পেছনে অনিয়ন্ত্রিত ছোট ছোট যানকেও দায়ী করা যায়। সড়কের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন আপদ হিসেবে দাঁড়িয়েছে মোটরসাইকেল। আমাদের এখনই উচিত এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা।
ঢাকা শহরের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আশঙ্কা করে বলা হয়, ২০৩০ সালের দিকে সড়কে যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে আসতে পারে।
২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার। চলতি বছরে এই গতি নেমে এসেছে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮২ কিলোমিটার। এই সব বয়সী মানুষের হাঁটার গড় গতি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। যেটি বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি।