রেসের গাড়ি কথা তো অনেক হলো। এবার নাহয় এমন গাড়ির কথা বলি, যা কিনা মাটি-পানি সবজায়গাতেই দাপটের সাথে এগিয়ে চলে! সাথে বিলাসিতার ব্যবস্থা তো আছেই! আর রেসের জন্য প্রস্তুতকৃত না বলে যে তার গতিসীমা খুব একটা কম, তাও নয়। গতির ক্ষেত্রেও দখল ছাড়েনি এই গাড়িটি।
জি, বলছিলাম ল্যান্ড রোভার গাড়ির কথা। ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া এই কোম্পানিটির প্রথম মালিকানা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ছিল ব্রিটিশ জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার কোম্পানি। পরবর্তীতে এটির মালিকানা স্থানান্তর হয় ভারতীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাটা মটরস এর কাছে (২০০৮ সালে)। এছাড়াও লেল্যান্ড মটর কর্পোরেশন এর কাছে ১৯৬৭-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এবং ব্রিটিশ লেল্যান্ড কোম্পানির কাছে ১৯৬৮-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ল্যান্ড রোভার কোম্পানির মালিকানা ছিল।
ল্যান্ড রোভার মূলত চার চাকায় চলতে সক্ষম এমন গাড়িগুলোই তৈরি করে থাকে। এসইউভি ও মিনি এসইউভি মডেলের গাড়িগুলোর মডেলগুলো হচ্ছে ডিফেন্ডার, ডিসকভারি, ফ্রিল্যান্ডার, রেঞ্জ রোভার, রেঞ্জ রোভার স্পোর্ট ইত্যাদি মডেলগুলো। বর্তমানে ইংল্যান্ড, ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে ল্যান্ড রোভার তাদের গাড়িগুলো বিক্রি ও সরবরাহ করে থাকে।
চলুন জানি, এই গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির কিছু অজানা তথ্য সম্পর্কে।
প্রথম সিরিজের ল্যান্ড রোভার বাজারে আসে এপ্রিল মাসে ১৯৪৮ সালে। যেটি ছিল চার চাকায় চলতে সক্ষম এমন দ্বিতীয় ব্র্যান্ডের গাড়ি (প্রথম ছিল জিপ নামক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ল্যান্ড রোভার আরো পরে শুরু করেছিল তাদের যাত্রা। সে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল আরো ৩০ বছর পরে। কারণ সেসময়টাতে ব্রিটিশ অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে একপ্রকার কালো অধ্যায় কিংবা খারাপ সময় চলছিলো বলা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সময়কার কথা, জিপ নামক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পরেই গাড়ি তৈরি করতে শুরু করে ল্যান্ড রোভার, সেসময় গাড়ির ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মরিস উইলস। যিনি ওয়েলসে একটি ফার্মের মালিকও ছিলেন।
তো মি. মরিস চেয়েছিলেন ফার্মের জন্যে কার্যপযোগী এমন একটি গাড়ি তৈরি করবেন যাতে থাকবে না কোনো ডান বা বাম স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং হবে খুবই সাধারণ। তাই তিনি ডান বা বামে নয় গাড়ির মাঝখানে রেখেছিলেন স্টিয়ারিং হুইলটিকে যাতে করে এটিকে ট্রাক্টরের মত করেও ব্যবহার করা যায়।
প্রথমদিকে সম্পূর্ণ প্রোডাকশনের পূর্বেই ২৫ টি গাড়ি বানিয়েছিল ল্যান্ড রোভার কর্তৃপক্ষ। যাদের মডেলের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ভেলার’। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষ ও ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৩ সালের দিকে, এই ২৫ টি ল্যান্ড রোভার গাড়ির একেকটি ভেলার মডেল বিক্রি হয়েছিলে ত্রিশ হাজার পাউন্ডের বেশি মূল্যে।
শিক্ষার্থীদের হাতে বই না তুলে দিয়ে তুলে দিয়েছিলো গাড়ি! কিন্তু কেন?
কারণ তেমন কিছুই না, একদিকে কোম্পানির প্রচার অন্যদিকে ভালো শিক্ষার প্রসার; এই মর্মার্থ প্রচারের জন্যে। ১৯৫০ সালে অক্সব্রিজের শিক্ষার্থীদেরকে ল্যান্ড রোভারের পক্ষ থেকে গাড়ি দেয়া হতো, যাতে তারা পুরো দেশ ঘুরে বেড়াতে পারে এবং ভালো শিক্ষার গুরুত্ব সকলের কাছে পৌছে দিতে পারে।
সাধারণত অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের শিক্ষার্থীদেরকে সিরিজ ওয়ানের গাড়িগুলো দেয়া হতো, যাতে করে তারা কেপ টাউনে যেতে ও আসতে পারে। আর লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত রেস করতে পারে। এবং এই রেসিং প্রতিযোগিতার খবর ১৯৫৬ সালে বিবিসিতে প্রচার করা হয়েছিল। যেখানে ডেভিড ওয়াটার ও আড্রিয়ান কাউওয়েলের মধ্যে রেসিং প্রতিযোগিতা হয়েছিল।
১৯৫০ সালে রোলস রয়েসের জেট টারবাইন ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী ইঞ্জিনিয়ার চার্লস এস. কিং রোলস রয়েসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে রেঞ্জ রোভারে যোগদান করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে উন্নতি সাধনের জন্যে রেঞ্জ রোভারের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
ইচ্ছা থাকলে কত কিছুই না করা যায়! ঠিক তাই করেছিলেন মি. স্কটসম্যান জেমস এ. কুহবার্টসন। কারণ তাঁর ছিল একটি ল্যান্ড রোভার গাড়ি, কিন্তু সেটিকে নিয়ে সেই সময়ে (১৯৫০ সাল) উঁচু-নিচু পাহাড়ের মত ও পাথরযুক্ত রাস্তা বেয়ে চলা অনেকটাই অসম্ভব ছিল। তাই তিনি গাড়িটির চারটি সিট বাদ দিয়ে গাড়িটিতে যুক্ত করে ট্যাংকের মত চাকা ও টায়ার। এর ফলে তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে উঁচু-নিচু রাস্তাতে চলাফেরা করতে পারতেন।
উঁচু-নিচু রাস্তায় চলাচলের জন্য নাহয় মি. জেমস এ. কুহবার্টসন ট্রাংক বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের গাড়িটিকে। কিন্তু অন্যদেরও কি একই কাজ করতে হবে নিজের এত টাকা দামের গাড়িটার সাথে?
না, তা আর করতে হয়নি। ব্রিটিশ বন কমিশনের অনুরোধে, বন-জঙ্গলে চলাচলে এমন একটি গাড়ির মডেল উদ্ভাবন করে ল্যান্ড রোভার কর্তৃপক্ষ। যেটি ছিল প্রথম মনস্টার ট্রাক, যেটি একই সাথে সাধারণ ও উঁচুনিচু সব রাস্তায় চলাচল করতে পারতো খুব সহজেই।
১৯৫০ সালের কথা, ল্যান্ড রোভার বাজারে নিয়ে আসে প্রথম ক্রসওভার এসইউভি মডেলের গাড়ি, যেটি কিনা সাধারণ গাড়ির মতো আরামদায়ক ছিল এবং যেকোনো রাস্তায় বিনা বাধায় চলতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সেসময় এই গাড়িগুলোর গুরুত্ব অনেকেই বুঝতে পারেনি এবং গাড়িগুলো তেমন জনপ্রিয়তাও পায়নি।
শুরুতেই যেমনটা বলা হয়েছিল, এই অংশটি সেটিরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ একবার নয় চারবার কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের এই ল্যান্ড রোভার কোম্পানি আজকের অবস্থানে এসেছে। যা বর্তমানে ভারতের টাটা মটরস কোম্পানির অধীনস্থ।
শুধু যে সাধারণ বিলাসবহুল গাড়ি তৈরি করে ল্যান্ড রোভার তা কিন্তু নয়, তৈরি করে শক্তসামর্থ্যবান কিছু গাড়িও। তাই তো বাদ রাখেনি মিলিটারি ক্ষেত্রও। গাড়ির মডেল হচ্ছে ১০১ ফরোয়ার্ড, যাতে ড্রাইভার সিটে বসেই টেনে নিয়ে যেতে পারেন ভারি ভারি যুদ্ধের কিংবা ত্রাণ সামগ্রী।
শুরুতেই বলেছিলাম, মাটি পানি দুই পথেই চলতে পারে এই গড়ি, তারই নমুনা দিতে হাজির এই ভাসমান ল্যান্ড রোভার গাড়ি। যদিও এটি একবারই তৈরি করেছিলো তারা। কারণ পরবর্তীতে তাদের গাড়িগুলোই পানিতে চলতে সক্ষম হয়েছে এবং এরকম ভাসমান বোট তৈরির প্রয়োজন হয়নি।
জাদুঘরে সাধারণত সভ্যতার নানা নিদর্শন কিংবা ছবি থাকে, কিন্তু গাড়ি ?
হ্যাঁ, ল্যুভর মিউজিয়ামে জায়গা করে নিয়েছে যেই গাড়িটি সেটি হচ্ছে ল্যান্ড রোভার গাড়ির একটি মডেল।
এই ছিল ল্যান্ড রোভার গাড়ির সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য। সামনে থাকছে অন্য কোনো গাড়ি নিয়ে আয়োজন।