আশরাফুল আলম:
কালের আবর্তে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় এবং কারখানায় উৎপাদিত হওয়ায় সোনারগাঁয়ে বিলুপ্ত প্রায় হাতের ভাজা মুড়ি। তবে বাঙালী ঐতিহ্যে প্রতি বছরই রমজান মাসে সব শ্রেণীর মানুষের ইফতারিতে মুড়ি ছাড়া চলেই না। ইফতারিতে যে কোন মানুষের কাছে খাবারের তালিকায় মুড়ি একটি সুপরিচিত নাম। সুস্বাদু ও স্বাস্থ্য সম্মত হওয়ায় মানুষের কাছে হাতের ভাজা মুড়ির এখনো রয়েছে আলাদা কদর। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরীব পরিবারের অন্যতম ইফতার আয়োজনে মুড়ির প্রাধান্য বেশি। ৮০ দশকের শুরুতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার শম্ভুপুরা ও পিরোজপুর দুটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে হাতের ভাজা মুড়ির বেশ ধুম ছিল। সারা বছর গ্রামগুলোতে কম বেশি মুড়ি ভাজা হলেও রমজান মাসে ছিল হাতে ভাজা মুড়ির বিশেষ চাহিদা। একারনে মুড়ি শিল্পে জড়িত নারী-পুরুষরা তখন দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ছিলেন। দিনরাত অভিরাম চলত মুড়ি ভাজার কাজ। সে সময় সোনারগাঁয়ের চাহিদা মেটানোর পর এই মুড়ি পাইকারী দরে হাত বদল করে নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, ট্রাকে করে চলে যেত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় হাঁটবাজারে। তৎকালীন সময়ে মুড়ি ভাজা কাজে জড়িতরা নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন এখন অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা সাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষায় ও রমজান উপলক্ষে এখনো সোনারগাঁয়ে পিরোজপুর ও শম্ভুপুরা দুটি ইউনিয়নের মঙ্গলেরগাঁও, তাতুয়াকান্দি ও দূর্গাপ্রসাদ এলাকার কিছু কিছু পরিবারে চলছে হাতে ভাজা মুড়ির কাজ ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রমজান উপলক্ষে সোনারগাঁ উপজেলার স্থানীয় দূর্গাপ্রসাদ, তাতুয়াকান্দি ও মঙ্গলেরগাঁও সহ কয়েকটি গ্রামে কিছু কিছু পরিবারে এখনো চলছে হাতে ভাজা মুড়ির কাজ। তবে ৯০ এর দশকে হাতে ভাজা মুড়ির ব্যাপক চাহিদার কারনে গ্রাম গুলোর মূল নাম হারিয়ে মুড়ি পল্লিতে পরিনত হয়েছিল। সে সময় প্রায় ৩ শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষ মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত হয়ে সংসারের স্বচ্ছলতা এনেছেন। সোনারগাঁয়ে যে মুড়ি ভাজা হয় তার বেশির ভাগই মালা, লোতা, বহুরী, ইরি, বি-২৯, বি-২৮, রত্মা ও বোরো ধানের মোটা চাউল দিয়ে। মুড়ি ব্যবসায়ীরা বরিশাল ও সিলেটের স্থানীয় ধানের বাজার থেকে এ ধান সংগ্রহ করে প্রথমে আধা সেদ্ধ করে থাকে। এরপর আবার পুরোপুরি সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে তা দিয়ে চাল বানানো হয়। এরপর সে চাল থেকে তৈরি হয় হাতে ভাজা মুড়ি। এখানকার মানুষ দুই ধরনের পদ্ধতিতে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে। স্বচ্ছলরা নিজেরাই বাজার থেকে ধান কিনে চাল তৈরিসহ মুড়ি ভেজে বাজারজাত করেন। এতে তারা বেশি লাভবান হয়। এরা প্রতি মণ মুড়িতে প্রায় ৪০০/ ৫০০ টাকা আয় করেন। অন্যদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন আড়ৎদারের কাছ থেকে চাল নিয়ে মুড়ি ভাজে। তবে মুড়ি তৈরিতে জ্বালানী কাঠ আনুসঙ্গিক কিছু খরচ বাদে মণ প্রতি তাদের ২৫০/৩৫০ টাকার ও বেশি আয় থাকে। সাধারণত ২ জন পূর্ণ বয়স্ক মহিলা প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই মন চাউলের মুড়ি ভাজতে পারে। তবে এ কাজে নারীরাই বেশি সময় দেন এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা পাওয়ায় তারাই বেশ সুখী।
দূর্গাপ্রসাদ এলাকার একজন মুড়ি ব্যবসায়ী বলেন, ৮০এর দশকে স্থানীয় তাতুয়াকান্দি, চৌধুরীগাঁও, কাজিরগাঁও, দূর্গাপ্রসাদ, মঙ্গলেরগাঁও, দুধঘাটা, কোরবানপুর, খাসেরগাঁও, পাচানী ও চরগোয়ালদী এলাকার মানুষ মুড়ি ভাজাকে তাদের পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন । সে সময় মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত ছিল প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার। তখন মুড়ি ভাজা একটি শিল্পে পরিনত হয়েছিল। মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত অনেক পরিবার তখন থেকেই অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হয়েছেন। যার ফলে এখানে গরীব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। বর্তমানে কারখানায় মুড়ি উৎপাদন হওয়ার কারনে এবং মানুষের জীবন মানের অনেকটা পরিবর্তন ঘটায় এখন হাতে ভাজা মুড়ি কাজে কেউ যেতে চায়না। তবে কারখানায় তৈরীর চিকন মুড়ির চেয়ে হাতের ভাজা মুড়ির দাম একটু বেশি। এতে কোন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয় না। যার ফলে এখনো হাতে ভাজা মুড়ির আলাদা কদর রয়েছে মানুষের কাছে।