মোঃ পলাশ শিকদারঃ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জমজমাট হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে আয়োজিত মাসব্যাপী লোকজ উৎসব ও কারুশিল্প মেলা। চিরায়ত বাংলার লোক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করতে ৩৩ বছর ধরে এ উৎসবের আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ১৬ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার পর লোকজ উৎসবের ১৮ এবং ১৯তম দিন শুক্র ও শনিবার মেলা প্রাঙ্গণ ছিল লোকে লোকারন্য। যেন উৎসব আর আমেজে মেতে উঠেছে ফাউন্ডেশন ও এর আশপাশ এলাকা।
শনিবার (৩রা ফেব্রুয়ারি) দুপুরের পর থেকে গ্রামের প্রতি নাড়ির চিরন্তন টান আর ভালবাসার আকর্ষণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলবদ্ধ ভাবে অনেকেই মেলায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসতে দেখা গেছে। এক কথায় সরকারি ছুটির দিন থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নানান বয়সী মানুষ এসেছেন এই উৎসবে। ছুটির দিনে লোক কারুশিল্প মেলা প্রাঙ্গণ পুরোপুরি মুখরিত। মেলার বিভিন্ন স্টল থেকে কেনাকাটা করেছেন আগত পর্যটকরা। দোকানীরাও খুশি ছুটির দিনের ক্রেতা সমাগমে।
দেশীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও লোকজ উৎসবে কর্মরত কারুশিল্পীদের লোকজীবন প্রদর্শনী, গ্রামীণ খেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীদের তৈরি বাহারি পণ্যসামগ্রী এবং উদ্যোক্তাদের কারুপণ্য বিক্রি হচ্ছে। উৎসবের মূল আকর্ষণ কর্মরত কারুশিল্প প্রদর্শনীতে উৎসুক দর্শনার্থীর প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ করা গেছে। মেলায় কারুশিল্পী প্রদর্শনীর ৩২ টি স্টলসহ ১০০টি স্টল বরাদ্ধ করা হয়েছে। দেশের ১৭টি জেলা থেকে ৬৪ জন কারুশিল্পী এ উৎসবে অংশ নিয়েছেন। তারা ফাউন্ডেশন চত্বরে তাদের কারুপণ্য তৈরি ও বিক্রি করছেন। সাধারণ মানুষ এ কারুপণ্য তৈরির কলাকৌশল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন।
সোনারগাঁয়ের কারুশিল্পীদের কারুকাজ খচিত হাতি-ঘোড়া, মমি পুতুল, জামালপুরের তামা-কাঁসা-পিতলের শৌখিন সামগ্রী, সোনারগাঁয়ের বাহারি জামদানি শিল্প, বগুড়ার লোকজ বাদ্যযন্ত্র, কক্সবাজারের শাঁখা ঝিনুক শিল্প, ঢাকার কাগজের শিল্প, রাজশাহীর মৃৎশিল্প, শখের হাঁড়ি, বাটিক শিল্প, খাদিশিল্প, মণিপুরী তাঁতশিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প, টাঙ্গাইলের বাঁশ-বেতের কারুপণ্য, সিলেটের বেতশিল্প, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুজনি কাঁথা, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা পুতুল, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজারের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, মৌলভীবাজারের বেতের কারুশিল্প। এছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ের বাঁশের কারুশিল্প, মাগুড়া ও ঝিনাইদহের শোলাশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, পাটজাত কারুপণ্য, লোকজ অলঙ্কার শিল্প, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, বায়স্কোপ ও মিঠাই-মণ্ডার পসরা বসেছে।
এছাড়াও ফাউন্ডেশনের ময়ূরপঙ্খী মঞ্চে লোকজ নাটক, লোক কাহিনীর যাত্রাপালা, বাউলগান, পালাগান, কবিগান, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান, জারি-সারি ও হাছন রাজার গান, লালন সংগীত, মাইজভান্ডারি গান, মুর্শিদী গান, গাঁয়ে হলুদের গান, বান্দরবান, বিরিশিরি, কমলগঞ্জের-মণিপুরী ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শরিয়তি-মারফতি গান, ছড়া পাঠের আসর, পুঁথি পাঠ, গ্রামীণ খেলা, লাঠি খেলা, দোকখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, লোকজ জীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্প বলা, পিঠা প্রদর্শনী ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ছুটির দিন উপলক্ষে সন্ধ্যায় মেলায় আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বাউল শিল্পীরা গান গাইছেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন দর্শনার্থীরা।
মেলার আগত দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলার সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে তারা সন্তুষ্টু। মেলায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও রয়েছে। মেলা চলাকালীন দেশী বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে ফাউন্ডেশন এলাকা। ছুটির দিনে পর্যটক বেশি হয়। মেলায় ঘুরতে আসা রাজশাহীর মোয়াজ্জেম হোসেন সোনালী বার্তাকে জানান, আমি ছুটির দিন উপলক্ষে ঘুরতে এসেছি। এখানকার পরিবেশ খুবই ভালো লাগছে।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম আজাদ সরকার জানান, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন। লোকজ উৎসব উপলক্ষে ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের টিম, আনসার সদস্য ও ট্যুরিস্ট পুলিশসহ বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এ মেলায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি পর্যটক আসছে।
গত ১৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই মেলা ও উৎসব চলবে প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ফাউন্ডেশন চত্বরে প্রবেশ মূল্য ছাত্রছাত্রীদের জন্য জনপ্রতি ৩০টাকা, অন্যান্য পর্যটকদের জন্য ৫০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা। তবে বিকেল ৫টার পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে প্রবেশাধিকার।