নিউজ সোনারগাঁ২৪ডটকম:
জাতিগত ভাবে আমরা বাঙ্গালী হওয়ার সুবাদে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ আমাদের নিজস্ব উৎসবে পরিনত হয়েছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে পহেলা বৈশাখ এখন সার্বজনীন একটি উৎসব। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাঙ্গালীর উৎসাহ, উদ্দিপনা আর আয়োজনের মাত্রা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি আজ থেকে ৫০ বছর পেছেনে ফিরে যাই তাহলে পহেলা বৈশাখ পালনের চিত্রটা কেমন দেখতে পাবো। তখন বাংলা নববর্ষ পালনে এখনকার মতো এত ঝাঁকজমক ছিল না। ছিল না উৎসবের এত বাহার। তবে সে সময় বৈশাখী মেলাসহ যেসব পারিবারিক আচার অনুষ্ঠান পালিত হতো সেগুলোতে প্রাণ ছিল। ছিল হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা অন্য রকম ভাল লাগা ভালবাসা। বর্তমানে পহেলা বৈশাখে নানামুখী উৎসবের আয়োজন করা হয়। পারিবারিক, সামাজিক এমন কি রাষ্ট্রীয়ভাবেও নববর্ষ পালনের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু উৎসবগুলোতে প্রাণ খুঁজে পাওযা যায় না। কারণ এখন সবাই একদিনের বাঙ্গালী হওয়ার চেষ্টা করেন। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ মানে বৈশাখী পোষাক আর পান্তা ইলিশের আয়োজন। আসলে আমরা যদি আমাদের শেকড়ের কাছে ফিরে যাই তাহলে এসব বৈশাখী পোষাক আর পান্তা ইলিশের অস্থিত্ব খুঁজে পাই না। হাল আমলে পহেলা বৈশাখে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৈশাখের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ম্লান করে দিচ্ছেন। পহেলা বৈশাখে ইলিশ কেনার অসম প্রতিযোগিতা, ৫শত টাকার ইলিশ ২হাজার টাকায় কেনা। বৈশাখী পোষাকের জন্য দরিদ্র পরিবারের শিশুর আত্মহত্যা এ চিত্র দেখার জন্যই বৈশাখ? আমি হলফ করে বলতে পারি বৈশাখে যারা পান্তা ইলিশ নিয়ে মাতামাতি করেন আর রঙ্গিন পোষাকের বাহার নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাদের অনেকেই বাংলা বারো মাসের নাম ঠিক মতো বলতে পারবেন না। বাঙ্গালী হিসেবে এটা কি লজ্জার নয়? দিন বদলের সাথে সাথে সময়ের চাহিদার কারণে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসরন করতে হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু বাঙ্গালী হিসেবে বাংলা বারো মাসের নাম বলতে না পারা এটা নিশ্চয় আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমাদের খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠি কিন্তু অবলীলায় বাংলা বারো মাসের নাম বলে দিতে পারেন। তারা কখনো মেকি বৈশাখ পালন করেন না। তারা ঐতিহ্যগত ভাবেই বৈশাখী রীতি পালনে বিশ্বাসী। বৈশাখ আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব সুতরাং এ উৎসবে আমাদের ঐতিহ্যকে লালন করাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কিন্তু এ দায়িত্বটা পালন করছে কে? নববর্ষের দিন আমাদের বাঙ্গালী চেতনা জাগ্রত হয়। একদিনের বাঙ্গালী হয়ে ছেলে মেয়েদের নিয়ে নেচে গেয়ে বৈশাখ পালন করে পরদিনই সবকিছু ভুলে কর্পোরেট জোয়ারে গা ভাসাই। ছেলে মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামি। বাংলা ভাষায় কথা বলা যেন শিশুদের অযোগ্যতা তাই তাদেরকে সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। ইংরেজিতে কথা বলা দোষনীয় নয়। তাই বলে বাংলা বলা যাবে না এটা কেমন কথা? বাংলার প্রতি যাদের এত এর্লাজি তাদের কী প্রয়োজন ঢাক ঢোল বাজিয়ে লোক দেখানো নববর্ষ উদযাপনের করার! পহেলা বৈশাখে এখনো গ্রাম গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। আমরা আমাদের শিশুদের নিয়ে এসব মেলায় গিয়ে কখনো কি দেশীয় মিষ্টান্ন কিংবা ঐতিহ্যবাহী খাবার চিনিয়েছি? আমাদের গ্রামীন বাঁশের বাঁশি, তালপাতার পাখা, কাঠের হাতি ঘোড়া, মাটির পুতুল এসবের সাথে কি পরিচয় ঘটিয়েছি? বাতাসা, খৈ, মুড়ি-মুড়কি, জিলাপী এসবের নাম কি জানে আমাদের শিশুরা? নাগরদোলা, লাঠি খেলা কিংবা পুতুল নাচ এসব সম্পর্কে কি ধারনা দিয়েছেন আপনার শিশুকে? যদি এ বিষয়গুলো সম্পর্কে শিশুরা না জেনে থাকে তাহলে আপনি নিজ উদ্যোগে তাদেরকে জানান। কারণ বাঙ্গালীর শেকড়ের সাথে মিশে আছে এসব ঐতিহ্য। এগুলোর সাথে পরিচয় না ঘটিয়ে রংচং মেখে সং সেজে বৈশাখ পালন করা শুধুই মরিচিকার পেছনে ছুটে চলা। বৈশাখ বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব। বৈশাখ বাঙ্গালীর ভালবাসা। এক কথায় বাঙ্গালীর হৃদয় জুড়েই বৈশাখ। এ বৈশাখ যেন বাঙ্গালীর বৈশাখ হয়েই বেঁচে থাকে আজীবন। আমরা যেন একদিনের বৈশাখী বাঙ্গালী না হই।
লেখক: সম্পাদক, চারদিক